- 25 August, 2022
- 0 Comment(s)
- 305 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
বিবাহের যেটা প্রথাগত রূপ, তা এখন পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু বিবাহ এখনও একটি জুলুমের সৃষ্টি করে যা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অনুভব করেন। তাঁরা উভয়েই যে বিমূর্ত, তাত্ত্বিক অধিকার ভোগ করেন--কেবল সেটি বিবেচনা করলে আজকের দিনে তাঁরা প্রায় সমান-সমান। একে-অপরকে তাঁরা আগের চেয়ে আরও অবাধে নির্বাচন করে নেন। আরও সহজে তাঁরা আলাদা হয়ে যেতে পারেন, বিশেষ করে আমেরিকায় যেখানে বিবাহবিচ্ছেদ একটি চলতি ব্যাপার। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এখন বয়স এবং সংস্কৃতির ফারাক আগের তুলনায় কম। স্ত্রীর দাবি করা স্বাধীনতাকে স্বামী আরও স্বেচ্ছায় স্বীকার করেন। সমানভাবেই তাঁরা পরিবারের যত্ন নেন। তাঁদের বিনোদনের মধ্যেও রয়েছে মিল : ক্যাম্পিং, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা ইত্যাদি। স্ত্রী এখন আর স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন কাটান না। তিনি খেলাধূলা করেন, বিভিন্ন সমিতি বা ক্লাবের সঙ্গেও যুক্ত। বাড়ির বাইরে তিনি ব্যস্ত থাকেন। এমনও মাঝেমধ্যে হয় যে, তিনি একটি ছোটোখাটো চাকরি করেন যেখান থেকে সামান্য হলেও তাঁর অর্থ উপার্জন হয়। অনেক তরুণ দম্পতিই নিখুঁত সমতার প্রতীতি দেন। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত দম্পতির অর্থনৈতিক দায়িত্ব স্বামীর কাছে সংরক্ষিত থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সমতা একটি বিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজের দাবি অনুসারে স্বামীই দাম্পত্য বাসস্থান স্থির করেন : স্ত্রী স্বামীর অনুবর্তী হন প্রদেশ থেকে প্যারিসে, প্যারিস থেকে প্রদেশে, উপনিবেশগুলিতে, বিদেশে। স্বামীর উপার্জন অনুযায়ীই প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁদের জীবনযাত্রার মান। স্বামীর কাজকর্মের ভিত্তিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় দিন, সপ্তাহ বা বছরের ছন্দ। স্বামীর পেশার ওপরেই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে বিভিন্ন সম্পর্ক এবং বন্ধুত্ব। স্ত্রীর চেয়ে সমাজে আরও ইতিবাচকভাবে মিশে যেতে পারার কারণে দম্পতির বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক ক্ষেত্রে দিশা দেখানোর বিষয়টি স্বামীই ধরে রেখেছেন। নারীর যদি নিজস্ব রোজগার করার উপায় না-থাকে, তাহলে তাঁর কাছে বিবাহবিচ্ছেদ একটি বিমূর্ত, তাত্ত্বিক সম্ভাবনা হয়েই থেকে যায়। আমেরিকাতে ‘খোরপোষ’ যদি পুরুষের জন্য একটি ভারী বোঝা হয়, তাহলে ফ্রান্সে মহিলাদের এবং হাস্যকর পেনশন পাওয়া পরিত্যক্ত মায়েদের ভাগ্যও একটি লজ্জাকর অনুভূতি। কিন্তু মৌলিক বৈষম্য এখান থেকেই উঠে আসে যে--কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে স্বামী অভীষ্টসিদ্ধি বা আত্ম-উপলব্ধি খুঁজে পেলেও স্ত্রীর ভূমিকায় একজন নারীর কাছে স্বাধীনতার রয়েছে শুধুমাত্র একটি নেতিবাচক চিত্র : অন্যদের মধ্যে মার্কিন তরুণীরা স্মরণ করিয়ে দেন ‘অবক্ষয়িত সময়পর্ব’-এর রোমান মহিলাদের মুক্তির কথা। আমরা দেখেছি দু-ধরনের আচরণের মধ্যে একটি তাঁদের বেছে নিতে হত। কেউ কেউ তাঁদের দিদা-ঠাকুমাদের জীবনযাত্রার শৈলী এবং সদ্গুণাবলিকে স্থায়ী করেছিলেন। অন্যরা বৃথা আন্দোলনে তাঁদের সময় কাটিয়ে দিয়েছিলেন। অনুরূপে, একই সংখ্যক মার্কিন মহিলাই ‘গৃহবধূ’ থেকে যান ঐতিহ্যিক মডেল বা ছাঁচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। অন্যদের মধ্যে বেশিরভাগই তাঁদের সময় আর শক্তি নষ্ট করেন। ফ্রান্সে দেখা যায়, পৃথিবীর সমস্ত শুভ ইচ্ছা স্বামীর থাকা সত্ত্বেও একজন যুবতী মহিলার মা হওয়ার পরেও বাড়ির কাজের বোঝা তাঁর ওপর আগের চেয়ে কম চেপে বসে না।
এটা ঘোষণা করা একটি সাধারণ বিষয় যে, আধুনিক পরিবারগুলিতে এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মহিলারা পুরুষদেরকে ক্রীতদাসের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। ব্যাপারটি কিন্তু নতুন নয়, যেহেতু গ্রিক পুরুষরা Xanthippe[1]-এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। আসলে যেটি সত্য সেটি হল, স্ত্রীরা এখন সেই সব ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করছেন যা বিগত দিনে তাঁদের কাছে নিন্দিত ছিল। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আমি এমন অনেক ছাত্রের স্ত্রীদেরকে জানি যাঁরা উন্মত্ত সংকল্প নিয়ে স্বামীদের সাফল্যের জন্য লেগেপড়ে থাকেন। স্বামীদের সময়সূচি, তাঁদের খাবার-দাবার নিয়ন্ত্রণ করেন। স্বামীদের কাজের তত্ত্বাবধান করেন। সমস্ত রকম চিত্তবিক্ষেপ থেকে স্বামীকে তাঁরা ছাড়িয়ে আনেন। স্বামীকে তাঁরা তালা-চাবি দিয়ে আটকে খালি রাখেন না। এটাও সত্য যে, এই স্বৈরতন্ত্রের সামনে পুরুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি ঢাল-তলোয়ারহীন। স্ত্রীর বিমূর্ত, তাত্ত্বিক অধিকার তিনি স্বীকার করেন এবং এও বোঝেন যে সেই অধিকার স্ত্রী কেবল তাঁর মাধ্যমেই বাস্তব রূপে পেতে পারেন। নিজের খরচেই তিনি শক্তিহীনতা এবং বন্ধ্যাত্বের জন্য স্ত্রীর ক্ষতিপূরণ দেবেন। তাঁদের সমিতির মধ্যে একটি আপাত সাম্যের বাস্তবায়নের জন্য পুরুষকেই সবচেয়ে বেশি দিতে হবে যেহেতু তাঁর আছেও বেশি। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বললে, স্ত্রী যেহেতু গ্রহণ করেন বা দাবি করেন, তার কারণ স্ত্রী হলেন দরিদ্রতর। প্রভু এবং ক্রীতদাসের দ্বান্দ্বিকতার সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট মূর্ত রূপ এখানে খুঁজে পাওয়া যায় : নিপীড়ন করতে করতেই একজন নিপীড়িত হন। পুরুষরা তাঁদের সার্বভৌমত্বের দ্বারা শৃঙ্খলিত। এর কারণ পুরুষরা একাই অর্থ উপার্জন করেন আর সেইটাকা তাঁর স্ত্রী দাবি করেন। কারণ পুরুষরা একাই একটি পেশার অনুশীলন করেন যে-পেশাতে স্বামী সফল হবেন বলে স্ত্রী দাবি করেন। কারণ পুরুষরা একাই উত্তরণকে মূর্ত করে তোলেন আর স্ত্রীরা চান তাঁদের কাছ থেকে সেই উত্তরণ বা উৎকর্ষকে চুরি করে নিয়ে তাঁদের প্রকল্প ও সাফল্যকে নিজের করে তুলতে। বিপরীতে, মহিলার দ্বারা পরিচালিত অত্যাচার কেবল তাঁর নির্ভরতাকেই প্রকাশ করে দেয়। একজন মহিলা জানেন যে, দম্পতির সাফল্য, দাম্পত্যের ভবিষ্যৎ-সুখ-ন্যায্যতা রয়েছে অন্য কারোর হাতে। এখন নারী যদি প্রবলভাবে চেষ্টা করেন পুরুষকে তাঁর নিজের ইচ্ছার বশীভূত করতে, তাহলে তাঁর কারণ তিনি তাঁর নিজের সত্তা স্বামীকেই সমর্পণ করে দিয়েছেন। নিজের দুর্বলতাকে অস্ত্র করতে চাইলেও আসল সত্য হল যে তিনি দুর্বল। দাম্পত্য দাসত্ব স্বামীর কাছে আরও দিনানুদৈনিক, আরও বিরক্তিকর। কিন্তু স্ত্রীর জন্য তা আরও গভীর। নিজে একঘেয়েমিতে ক্লান্ত বলে যে স্ত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্বামীকে নিজের কাছে রাখেন, তিনি অবশ্যই স্বামীর বিরক্তির কারণ হন এবং স্বামীর ওপর ভারস্বরূপ চেপে বসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্ত্রীকে ছাড়া স্বামী যত সহজে থাকতে পারেন, স্ত্রী ততটা পারেন না স্বামীকে ছাড়া। স্বামী যদি স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যান, তাহলে স্ত্রীর জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। বড়ো পার্থক্য হল--স্ত্রীদের ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতা একেবারে ভেতরে গেঁথে যায়। আপাত-স্বাধীনভাবে আচার-ব্যবহার করলেও স্ত্রী একজন ক্রীতদাস। সেখানে পুরুষ মূলত স্বাধীন এবং তাঁর বন্ধন আসে বাইরে থেকে। এখন স্বামীর যদি ধারণা হয় যে তিনিই শিকার, তাহলে তার কারণ যে-বোঝা তিনি মেনে নেন তা অনেক বেশি সুস্পষ্ট : পরজীবীর মতো স্ত্রী স্বামীর খেয়ে-পরে বেঁচে থাকেন। পরজীবী কিন্তু বিজয়ী কর্ত্রী নন। প্রকৃতপ্রস্তাবে, জৈবিকভাবে পুরুষ এবং মহিলারা যেমন কখনোই একে-অপরের শিকার হন না বরং তাঁরা উভয়ই মানবপ্রজাতির শিকার, অনুরূপে স্বামী-স্ত্রীও এমন একটি প্রতিষ্ঠানের নিপীড়নের শিকার হন যে-প্রতিষ্ঠান তাঁরা তৈরি করেননি। যদি বলা হয় যে,পুরুষরা নারীদের অত্যাচার করেন, তাহলে স্বামীরা রাগান্বিত প্রতিক্রিয়া দেন। স্বামীরাই নিপীড়িত বোধ করেন : স্বামীরাই করেন। আসল ব্যাপার হল, পুরুষালি নিয়মাবলি, পুরুষের দ্বারা এবং পুরুষের স্বার্থে পরিচালিত সমাজ এমন একটি রূপে বা কাঠামোতে মহিলাদের অবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করে দিয়েছে যা বর্তমানে পুরুষ ও নারী উভয় লিঙ্গের জন্যই যন্ত্রণার উৎস।
স্বামী-স্ত্রীর যৌথ স্বার্থেই পরিস্থিতির পরিবর্তন করা উচিত বিবাহকে মহিলাদের জন্য একটি ‘ক্যারিয়ার’ হিসাবে নিষিদ্ধ করে দিয়ে। যে-সমস্ত পুরুষ নিজেদেরকে নারীবিরোধী ঘোষণা করেন এই অজুহাতে যে “এটার মতো মহিলারাও যথেষ্ট পরিমাণ বিষাক্ত”--তাঁরা যুক্তি ছাড়াই কারণ দেখান। এর যথাযথ কারণ হল বিবাহ মহিলাদের ‘শিকারি পতঙ্গ’, ‘জোঁক’ বা ‘বিষাক্ত’ করে তোলে। ফলত, বিবাহ বিষয়টির রূপান্তর প্রয়োজনীয়, আর এর ফলস্বরূপ সাধারণভাবে প্রয়োজন মহিলাদের অবস্থার বদল ঘটানো। পুরুষের ওপর মহিলারা অত্যন্ত ভারস্বরূপ চেপে বসেন কারণ একজন মহিলাকে তাঁর নিজের ওপর নির্ভর করতে নিষেধ করা হয়েছে। নারীকে মুক্ত করার মাধ্যমে পুরুষ আসলে নিজেকেই মুক্ত করেন, অর্থাৎ, এই পৃথিবীতে নারীকে করার মতো কিছু দেন।
এমন কিছু তরুণী আছেন যাঁরা ইতিমধ্যেই এই ইতিবাচক স্বাধীনতাকে জয় করার চেষ্টা করছেন। তবে, সেই সব মহিলার সংখ্যা বিরল যাঁরা তাঁদের পড়াশোনা বা পেশায় দীর্ঘ সময় ধরে অধ্যবসায় অক্ষুণ্ন রেখেছেন। সচরাচর তাঁরা ভালোভাবেই জানেন যে, স্বামীর ক্যারিয়ারের কাছে তাঁদের কাজের স্বার্থ বলিপ্রদত্ত হবে। সংসারের জন্য তাঁরা কেবল বাড়তি বেতনটুকুই নিয়ে আসবেন। কেবল ওপর-ওপরভাবে তাঁরা এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন যা তাঁদেরকে বৈবাহিক দাসত্ব থেকে উদ্ধার করবে না। এমনকি যাঁদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা রয়েছে, তাঁরাও তা থেকে পুরুষের সমান সামাজিক সুবিধা অর্জন করেন না। উদাহরণস্বরূপ, পুরুষ আইনজীবীদের মৃত্যুর পর তাঁদের স্ত্রীরা পেনশন পাওয়ার অধিকারী। যদিও বিপরীতে, মহিলা আইনজীবীদের মৃত্যুর পর তাঁদের স্বামীদের একই অনুপাতে পেনশন দেওয়াকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এর মানে হল, কর্মরত মহিলাদের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় না যে,স্বামীদের মতো তাঁরাও নিজেদের অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর একই জীবন-স্তর বজায় রাখবেন। এমন অনেক নারী আছেন যাঁরা তাঁদের পেশাতেই প্রকৃত স্বাধীনতা খুঁজে পান। কিন্তু অনেকেই আছেন যাঁদের জন্য বৈবাহিক কাঠামোর মধ্যে ‘বাইরের’ কাজ একটি অতিরিক্ত ক্লান্তির প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র। অধিকন্তু, প্রায়শই, একটি শিশুর জন্ম তাঁদের বাধ্য করে গৃহিণীর ভূমিকায় নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখতে। বর্তমানে পরিস্থিতিতে, কাজ এবং মাতৃত্বের সমন্বয় করা খুবই কঠিন।
সঠিকভাবে বললে, ঐতিহ্য অনুসারে একজন শিশুরই উচিত একজন মহিলার প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, যে-স্বাধীনতা অন্য কোনো লক্ষ্যে একান্তভাবে নিয়োজিত হওয়ার থেকে তাঁকে মুক্তি দেবে। একজন স্ত্রী হিসাবে যদি সেই মহিলা পরিপূর্ণ ব্যক্তি না-হন, তবে তিনি তা হয়ে ওঠেন একজন মা হিসাবে। সন্তানই হল তাঁর আনন্দ, তাঁর ন্যায্যতা। সন্তানের মাধ্যমেই যৌন ও সামাজিকভাবে তিনি তাঁর আত্মোপলব্ধিকে সুসম্পন্ন করে তোলেন। ফলত সন্তানের মাধ্যমেই বৈবাহিক প্রতিষ্ঠান তার নিজের অর্থ খুঁজে পায় এবং নিজস্ব লক্ষ্য অর্জন করে। আসুন, আমরা একজন নারীর বিকাশের এই সর্বোচ্চ পর্যায়টি পরীক্ষা করি।
0 Comments
Post Comment